ইলেক্ট্রনিক্স

 ইলেক্ট্রনিক্স (Electronics) হলো তড়িৎ প্রকৌশলের একটি শাখা, যা মূলত অর্ধ-পরিবাহী (semiconductor) বা শূন্য টিউবের (vacuum tube) মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা, এর সুবিধাগুলো ব্যবহার করা এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্র তৈরি করা নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করে। 

ইলেক্ট্রনিক্স সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে, এর ইতিহাস, মূল শাখাগুলো এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।

১. ইলেক্ট্রনিক্সের ইতিহাস ও বিবর্তন

ইলেক্ট্রনিক্সের ইতিহাসকে মূলত তিনটি প্রধান যুগে ভাগ করা যায়:

  • ১. ভ্যাকুয়াম টিউব যুগ (১৯০৪ - ১৯৫০):

    • সূচনা: ১৯০৪ সালে জন অ্যামব্রোস ফ্লেমিং প্রথম "থার্মোনিক ভাল্ভ" বা ভ্যাকুয়াম টিউব আবিষ্কার করেন। এটি ছিল প্রথম সত্যিকারের ইলেকট্রনিক ডিভাইস যা ইলেকট্রনের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত।

    • প্রয়োগ: বেতার (রেডিও), টেলিভিশন এবং প্রথম প্রজন্মের বিশাল আকারের ডিজিটাল কম্পিউটার (যেমন ENIAC) মূলত এই টিউবের উপর নির্ভর করত।

  • ২. ট্রানজিস্টর যুগ (১৯৪৭ - ১৯৬০):

    • বিপ্লব: ১৯৪৭ সালে বেল ল্যাবরেটরিতে জন বারডিন, ওয়াল্টার ব্র্যাটেইন এবং উইলিয়াম শকলি ট্রানজিস্টর আবিষ্কার করেন।

    • গুরুত্ব: ট্রানজিস্টর ভ্যাকুয়াম টিউবের তুলনায় অনেক ছোট, দ্রুত, কম বিদ্যুৎ খরচ করে এবং অধিক নির্ভরযোগ্য ছিল। এর ফলে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির আকার নাটকীয়ভাবে ছোট হতে শুরু করে।

  • ৩. ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC) যুগ (১৯৫৮ - বর্তমান):

    • আধুনিক ভিত্তি: ১৯৫৮ সালে জ্যাক কিলবি এবং রবার্ট নয়েস ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC) বা "মাইক্রোচিপ" আবিষ্কার করেন।

    • প্রভাব: একটি ছোট সিলিকন চিপের উপর হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ ট্রানজিস্টর, রেজিস্টর এবং অন্যান্য উপাদানকে একত্র করার এই প্রযুক্তি ইলেকট্রনিক্সকে এক নতুন স্তরে নিয়ে যায়। আজকের কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, এবং অন্যান্য সব আধুনিক ডিজিটাল ডিভাইস এই আইসি বা চিপের উপর নির্ভরশীল। মুরের সূত্র (Moore's Law) অনুযায়ী, প্রতি দুই বছরে একটি চিপের ট্রানজিস্টর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে, যা প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির মূল কারণ।

২. ইলেক্ট্রনিক্সের প্রধান শাখাসমূহ

ইলেক্ট্রনিক্স প্রকৌশলকে প্রধানত নিম্নলিখিত শাখাগুলিতে ভাগ করা যায়:

শাখার নামমূল আলোচনা ক্ষেত্রউদাহরন
অ্যানালগ ইলেক্ট্রনিক্সঅবিচ্ছিন্ন বৈদ্যুতিক সংকেত (Continuous Signals) নিয়ে কাজ করে। এটি ভোল্টেজ এবং কারেন্ট পরিবর্ধন ও ফিল্টারিংয়ে ব্যবহৃত হয়।এমপ্লিফায়ার, ফিল্টার, অপ-অ্যাম্প (Operational Amplifier), পুরনো রেডিও সিস্টেম।
ডিজিটাল ইলেক্ট্রনিক্সবিচ্ছিন্ন সংকেত (Discrete Signals), অর্থাৎ বাইনারি সংখ্যা (০ এবং ১) নিয়ে কাজ করে। তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সঞ্চালনে ব্যবহৃত হয়।মাইক্রোপ্রসেসর, লজিক গেট, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ডিজিটাল ঘড়ি।
পাওয়ার ইলেক্ট্রনিক্সউচ্চ শক্তি এবং উচ্চ ভোল্টেজে বিদ্যুৎকে নিয়ন্ত্রণ ও রূপান্তর নিয়ে কাজ করে।AC-কে DC তে রূপান্তর (Rectifier), মোটর নিয়ন্ত্রণ, সোলার ইনভার্টার, ইউপিএস (UPS)।
কমিউনিকেশন ইলেক্ট্রনিক্সতথ্যের আদান-প্রদান এবং প্রেরণের জন্য সার্কিট ডিজাইন নিয়ে কাজ করে।মোবাইল নেটওয়ার্ক (4G/5G), ওয়াইফাই (Wi-Fi), স্যাটেলাইট যোগাযোগ, রেডিও।
মাইক্রোইলেক্ট্রনিক্সইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC) বা চিপের ডিজাইন, গবেষণা এবং ক্ষুদ্রাকৃতির উপাদান তৈরির পদ্ধতি নিয়ে কাজ করে।মাইক্রোপ্রসেসর, মেমরি চিপ (RAM, ROM)।

৩. ইলেকট্রনিক্স এবং ইলেকট্রিক্যালের মধ্যে পার্থক্য

অনেকেই ইলেকট্রনিক্স এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-কে গুলিয়ে ফেলেন। এদের মূল পার্থক্য হলো:

বৈশিষ্ট্যইলেকট্রিক্যাল (Electrical)ইলেকট্রনিক্স (Electronics)
মূল উদ্দেশ্যবিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন, সঞ্চালন এবং ব্যবহার।ইলেকট্রন প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তথ্য/সংকেত প্রক্রিয়াকরণ।
মূল উপাদানপরিবাহী (Conductor) পদার্থ (যেমন: তামা)।অর্ধ-পরিবাহী (Semiconductor) পদার্থ (যেমন: সিলিকন, জার্মেনিয়াম)।
কাজের উদাহরণমোটর, জেনারেটর, ট্রান্সফর্মার, পাওয়ার গ্রিড।ট্রানজিস্টর, আইসি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন।
ভোল্টেজ স্তরসাধারণত উচ্চ ভোল্টেজ (High Voltage)।সাধারণত নিম্ন ভোল্টেজ (Low Voltage)।

৪. প্রয়োগের ক্ষেত্র

ইলেক্ট্রনিক্স এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এর ব্যবহার নেই। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো:

  1. তথ্যপ্রযুক্তি (IT): কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মেমরি ডিভাইস।

  2. যোগাযোগ: মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট রাউটার, ফাইবার অপটিক সিস্টেম, স্যাটেলাইট।

  3. স্বয়ংক্রিয়তা ও রোবোটিক্স: শিল্প কারখানার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, রোবট, সেন্সর এবং অ্যাকচুয়েটর।

  4. চিকিৎসা: ইসিজি (ECG), এমআরআই (MRI) মেশিন, পেসমেকার।

  5. ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স: টেলিভিশন, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, স্মার্ট হোম ডিভাইস।

  6. মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা: রাডার, নেভিগেশন সিস্টেম, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি।

ইলেক্ট্রনিক্স হলো আধুনিক সভ্যতার মূল চালিকাশক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম।

Post a Comment

Previous Post Next Post